ক্রেতাও ক্রাইম রিপোর্টার! মো. আব্দুল হামিদ
ইউনাইটেড এয়ারে ট্রাভেল করার সময় অসতর্কতার সাথে হ্যান্ডেল করায় বিখ্যাত এক সঙ্গীত পরিচালক Dave Carroll এর গিটারটি ভেঙ্গে যায়। প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং ক্ষতিপূরণ দাবী করেন। কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত না করায় বেশ কিছুদিন পরে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেন United Breaks Guitars গানটি। তা দ্রুতই বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ইউটিউবে এখনো অনেক ভক্তকে মন্তব্য করতে দেখা যায় যে, ওই ঘটনার প্রতিবাদস্বরূপ তারা আর কখনো ইউনাইটেড এয়ারে ভ্রমণ করবে না! তাহলে ওই বিমান কর্তৃপক্ষ ঠিক কী পরিমাণ আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতির শিকার হয়েছে বা হচ্ছে–তা কি অর্থমূল্যে পরিমাপ করা সম্ভব?
এখনকার দিনে এটা খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার। আপনি বিচ্ছিন্ন একজন ক্রেতাকে অবজ্ঞা করতেই পারেন। কিন্তু তার হাতে থাকা স্মার্টফোনের ত্রিশ সেকেন্ডের এক ভিডিও আপনার ব্র্যান্ডের কী পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে তা কল্পনাতীত। স্পেনের জিরোনার এক হোটেল ম্যানেজার আমাদের একটি কোর্স পড়ানোর সময় এবিষয়ে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন। খুব সতর্ক থাকার পরেও তাদের হোটেলের বাথটাবে কীভাবে যেন একটা তেলাপোকা ঢুকে পড়ে। একজন ক্লায়েন্ট সেটা ভিডিও করে তার অভিজ্ঞতা রিভিউ আকারে লিখে নিজস্ব ব্লগে ভিডিওটি জুড়ে দেয়।
অল্প কয়েকদিনে তা ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়ে যায়। এমনকি বহু বছরের পুরোনো কাস্টমারও ফোন করে নিশ্চিত হতে চায়–সত্যিই তাদের তেলাপোকার মুখোমুখি হতে হবে কি না! পরে তারা সেই ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ করে উচ্চ ক্ষতিপূরণ দিয়ে, ক্ষমা চেয়ে তবে ভিডিওটি প্রত্যাহার করান। কারণ তারা বুঝতে পারছিলেন–হাজার ইউরোর বিজ্ঞাপন সম্ভাব্য ক্রেতারা বিশ্বাস করছে না। অথচ অচেনা অজানা এক কাস্টমারের কথা বিশ্বাস করে তারা ওই হোটেলে না ওঠার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে!

১৯৯২ সালে হুভার (ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্র্যান্ড) এবং ইয়োর লেইজার (ট্রাভেল এজেন্সী) যৌথভাবে এক প্রমোশনাল অফার দেয়। ঘোষণা ছিল যে, ন্যূনতম ১০০ পাউন্ডের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার কিনলে যুক্তরাষ্ট্রে দুটো টিকেট ফ্রি দেওয়া হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে (?) সেই অফার এতটাই সাড়া জাগিয়েছিল যে, তারা চাহিদা মোতাবেক পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি। অসংখ্য ক্রেতা সেই পণ্য কিনতে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়। ফলে মানুষ বিরক্ত হয়ে উভয় কোম্পানীর সমালোচনা করতে শুরু করে। কথায় বলে না দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ছোটে–ঠিক তেমনটা। এতদিন যারা তাদের নামও জানত না, তারাও তাদের ‘প্রতারণা’র বিষয়ে সোচ্চার হয়। এতদিনের ইমেজ নয়, বরং তারা যে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে–সেটাই ক্রেতাদের কাছে মূখ্য হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশেও এমন উদাহরণ পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের দিকে এক টুথপেস্ট কোম্পানি তাদের বিশেষ সাইজের টুথপেস্ট কিনলেই একটি ইয়ারফোন ফ্রি দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তখন টিভিতে প্রচার হচ্ছিল যে, বাজারে সেটা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দোকানে গেলে বিক্রেতারা বলে, এখনো সেই পণ্য তাদের কাছে পৌঁছায়নি। আমার সামনেই বেশ ক’জন তরুণ সেটা খোঁজ করে না পেয়ে, বিরক্ত হয়ে সেই ব্র্যান্ডকে ‘বাটপার’ বলে গালাগাল শুরু করে! আসলে তখনকার দিনে ওই টুথপেস্টের দামের চেয়ে সেই ইয়ারফোনের দাম ছিলবেশি। ফলে প্রমোশনাল অফার হিসাবে কোম্পানি শুরুতে সীমিত সংখ্যক বাজারে ছাড়ার পর, ব্যাপক চাহিদা দেখে সেটার সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু টিভিতে তখনো বিজ্ঞাপনটি চলছিল। ফলে এই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে বলে অনুমান করা যায়!
ছাড়, ফ্রি, বোনাস ইত্যাদি হলো ঝিমিয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য। উন্নত দেশে ক্লিয়ারিং সেল সম্পর্কে ক্রেতাদের অনেকটা ইতিবাচক মনোভাব থাকায়–তারা সেটা থেকে উপকৃত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ-রকম সেল হওয়ার মানে হলো–পচা বা লো-কোয়ালিটি মাল খালাস করার ধান্ধা! ফলে সচেতন ও সামর্থ্যবান ক্রেতারা ওটার প্রতি সন্দেহজনক মনোভাব পোষণ করে। তাই বিশেষ অফার বা ছাড় থেকে কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়।
তাছাড়া যেকোনো বিষয়ে অসন্তুষ্ট একজন ক্রেতা যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দেয়, ভিডিও আপলোড করে, লাইভে গিয়ে তার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার দৃশ্যটি প্রচার করে কিংবা ব্লগে/কোম্পানির ওয়েবসাইটে গিয়ে রিভিউ ছাড়ে বা কমেন্ট করে–অচেনা মানুষেরাও তার কথা বিশ্বাস করবে। আপনার প্রতিষ্ঠান যত ক্ল্যারিফিকেশনই দিক না কেন–ক্রেতারা তা কানে তুলবে না। তাই পণ্যের উৎপাদন, বণ্টন ও মূল্যনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। প্রচারণারক্ষেত্রেও বিশ্বাসযোগ্য থাকতে হবে–নইলে পতন অনিবার্য।